লোকটা জানলই না
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
বিষয়সংক্ষেপ: লােকটা তার বাঁদিকের বুক-পকেটটা সামলাতে সামলাতেই তার একাল-ওকাল নষ্ট করল। অথচ পকেটের নীচেই ছিল আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতাে হৃদয়। লােকটা সেই সম্পর্কে কিছু জানলই না। তার আর্থিক উন্নতি ঘটল অনেক। বাড়িও হল সুরক্ষিত। গােগ্রাসে দুটো গিলে সে ছুটে বেড়াল টাকার পিছনে আর তার অজ্ঞাতেই খসে পড়ল তার জীবন।
নামকরণ: সাহিত্যে নামকরণ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নামকরণের মধ্য দিয়েই পাঠকরা বিষয়বস্তুর স্বাদ কেমন হতে পারে, তা অনুমান করতে পারে। নামকরণ প্রধাণত নানা রকমের হতে পারে—বিষয়মুখী, চরিত্রপ্রধান, ব্যঞ্জনাধর্মী। কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় আলােচ্য কবিতাটির নামকরণ করেছেন ‘লােকটা
হাতে কলমে
১.১ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম কী ?
উঃ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম হল- ‘পদাতিক।
১.২ তাঁর লেখা দুটি গদ্যগ্রন্থের নাম লেখাে।
উঃ তাঁর লেখা দুটি গদ্যগ্রন্থ হল- “আমার বাংলা এবং ‘টানাপােড়েনের মাঝখানে।
২ নীচের প্রশ্নগুলির সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :
২.১ বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে ...' —এখানে বা দিকের বুক পকেট’ বলতে কী বােঝানাে হয়েছে ?
উঃ উদ্ধৃত পঙক্তিটি কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের ‘লােকটা জানলই না’ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। ‘বাঁ-দিকের বুক-পকেট’ বলতে কবি লােকটির প্রাণে বেঁচে থাকার ঐকান্তিক আগ্রহে অর্থ উপার্জন ও তা রক্ষা করার সার্বিক চেষ্টাকে বুঝিয়েছেন। সাংসারিক, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ সাধারণত তার অত্যাবশ্যকীয় প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র বিশেষত অর্থ নিজেদের জামার বাম দিকের পকেটে রাখে। কিন্তু, সৃষ্টিকর্তার দান, দেহের বাম দিকে থাকা হৃদয়ের খোঁজ সে করে না। বাহ্য সম্পদের প্রতি মানুষ এতই মােহমুগ্ধ হয়ে পড়ে যে, জীবনের মূল উদ্দেশ্য হৃদয়বত্তার বিকাশের কথা সে ভাবে না। মানুষ তার অর্থ ও সম্পত্তির দিকটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। কবির ভাবনায় এটি হওয়া অনুচিত। তাই মানুষের উপার্জনসর্বস্ব মানসিকতার দিকটি কটাক্ষ করে, কবি আলােচ্য কথাটি বলেছেন।
২.২ ইহকাল পরকাল’ —এই শব্দদ্বয় এখানে কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ?
উঃ ইহকাল' কথার অর্থ হল— ব্যক্তির পার্থিব আয়ুষ্কাল আর ‘পরকাল’ কথার অর্থ হল— মৃত্যুপরবর্তী জীবন। জীবদ্দশায় মানুষ পার্থিব রীতিনীতি, আচার আচরণ পালন করে। কিন্তু, ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় পৃথিবীর সৌন্দর্য, রূপ-রস-গন্ধ সে উপভােগ করতে পারে না। ইহকালে বাবা-মা-ভাই-বােন-স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়স্বজন নিয়ে সে এতটাই বিমােহিত থাকে যে মনুষ্যত্ববােধ, পরােপকরিতা, সহমর্মিতা, মানবধর্ম নিয়ে সে ভাবেই । জাগতিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনকেই সে সর্বস্ব মনে করে। সে বােঝে না মানুষের অস্তিত্ব— তার জীবনের আসল মূল্য নির্ধারিত হয় তার মঙ্গলময় কল্যাণপূত কর্মের মাধ্যমে। আলােচ্য ইহকাল ও পরকাল’ শব্দের মাধ্যমে কবি আত্মসর্বস্ব মানুষের জীবনবিচ্ছিন্ন ভাবনার প্রতি করুণা দেখিয়ে তির্যক ভঙ্গিমায় কথাটি বলেছেন
২.৩ কবিতায় লােকটির দু-আঙুলের ফাঁক দিয়ে কী খসে পড়ল ?
উঃ পদাতিক কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের লেখা ‘লােকটা জানলই না’ কবিতায় বর্ণিত লােকটির দু-আঙুলের ফাঁক দিয়ে তাঁর জীবন খসে পড়ল। অর্থ উপার্জন ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে করতে লােকটি এতই মােহান্ধ হয়ে পড়ে যে, সে জীবনের মূল উদ্দেশ্য—হৃদয়বৃত্তির বিকাশ ঘটানাের ক্ষেত্রে মােটেই সচেষ্ট হয় না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা লােকটি এভাবে চলতে চলতে একদিন মারা যায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া ও জাগতিক সম্পদের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে থাকা থেকে হঠাৎই আগাম সতর্কতা নাজানিয়ে দুই আঙুলের ফাঁক দিয়ে জীবন তারা খসে পড়া অর্থাৎ, এই পৃথিবীতে তার আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার কথাই কবি বুঝিয়েছেন।
২.৪ ‘আলাদিনের চর্য প্রদীপ’ আসলে কী ? তাকে এরকম বলার কারণ বুঝিয়ে দাও।
উঃ পদাতিক কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় ‘লােকটি জানলই না’ কবিতায় মানুষের হৃদয়কে ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপএর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আরব্য রজনী’ গল্পে বর্ণিত আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ এক ধরনের মায়াপ্রদীপ, যার দ্বারা অসাধ্যসাধন করা যায়। তবে এখানে কবি ‘আশ্চর্য-প্রদীপ’ বলতে হৃদয়কে বুঝিয়েছেন।
তাকে এরকম বলার কারণ হল, আলাদিন যেমন তার প্রদীপ দিয়ে অসাধ্যসাধন করে, মানুষও তেমনই তার হৃদয় দিয়ে অনেক অসম্ভব কাজকে সম্ভব করতে পারে।
৩ নীচের প্রশ্নগুলির সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :
৩.১ ‘লােকটা জানলই না’ পঙক্তিটি দু-বার কবিতায় আছে। একই পঙক্তি একাধিকবার ব্যবহারের কারণ কী ?
উঃ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় ‘লােকটা জানলই না’ কবিতাটিতে প্রশ্নোক্ত পঙক্তিটি দু-বার ব্যবহার করেছেন। প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছে কবিতায় বর্ণিত লােকটির বামদিকের বুক পকেটের সামান্য নীচে থাকা ‘হৃদয়’-এর সন্ধান -পাওয়ার প্রসঙ্গে। আর দ্বিতীয়বার ব্যবহৃত হয়েছে। নিজের অজ্ঞাতেই সেই হৃদয় ও তার অমূল্য জীবন হারিয়ে ফেলার প্রসঙ্গে। কবিতার নামকরণেও পঙক্তিটি ব্যবহার করে কবি মানব জীবনের উদ্দেশ্যকে, তার মর্মার্থকে অধিকতর স্পষ্টতা দিয়েছেন। তা ছাড়া, একাধিকবার একই কথার উল্লেখ ও ভাবের পুনরাবৃত্তি তার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দেয়। বিষয় ও ভাবনাকে সবার সামনে এনে তাকে উপলব্ধি করানাের চেষ্টা করা হয়। কবিও পাঠকের সামনে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য, মানুষ যেন জীবনের মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সচেষ্ট হয়। তাই পঙক্তিটি একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে।
৩.২ কবি ‘হায়-হায়’ কোন প্রসঙ্গে বলেছেন ? কেন বলেছেন ?
উঃ পদাতিক কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় তাঁর ‘লােকটা জানলই না’ কবিতায় খেদ, অনুতাপ ও আক্ষেপ প্রকাশক ‘হায়-হায়’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাবধানী মানুষের আত্মসর্বস্ব সঞয়ী জীবনের অনিবার্য উদ্দেশ্যহীন শােচনীয় পরিণাম প্রসঙ্গে কবি শব্দটির প্রয়ােগ করেছেন।
জীবনে অর্থ উপার্জন, সঞয় ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যতীত লােকটি কোনাে মহৎ কার্য করেনি। অথচ, মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই কর্তব্য জীবনে পরের জন্য কিছু করা— মানবিক কার্য সম্পাদন করা। যেখানে অনন্ত সম্ভাবনায় জীবনের মহত্তর প্রকাশ হতে পারত, সেখানে কেবল সকীর্ণতার ক্ষুদ্র ভাবকে আকড়ে ধরেই লােকটির জীবন কেটে গেল। আর এভাবেই সে নিজের ইহকাল, পরকাল দুটিই শেষ করেছে। অর্থ উপার্জন করেও তাকে মানবজাতির কল্যাণের কাজে খরচ করেনি। তারপর আচমকাই একদিন তার নশ্বর জীবন শেষ হল। কিন্তু একথাও সত্যি যে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষকে পৃথিবী মনে রাখে না। তাই আত্মসর্বস্ব মানুষের জীবনের অসারতা, অসহায়তা, মূল্যহীনতা ও বেদনার স্বরূপ তুলে ধরতেই কবি ‘হায়-হায়’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন।
৩. ৩ কবিতাটির নামকরণ যদি হত ‘হৃদয়’ বা ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ তাহলে তা কতটা সার্থক হত ?
উঃ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় তাঁর লেখা পাঠ্যাংশের আলােচ্য কবিতার নামকরণ করেছেন ‘লােকটা জানলই না । কবিতার মূল বিষয়টি হল লােকটি তার নিজের হৃদয় সম্পর্কে নিজেই খোঁজ রাখে না। সেদিক থেকে নামকরণটি কবিতার মূল ভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
কবিতাটিতে ‘হৃদয়’ বা ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ প্রভৃতি শব্দাবলি থাকা সংগত। কারণ, এইসব নিয়েই কবিতা। কিন্তু নামকরণটি এরকম হলে ভালাে হত না, কারণ, কবির বক্তব্য-বিষয় হল মানুষের একধরনের অজ্ঞতা। যদিও অজ্ঞতা কেবলমাত্র হৃদয় সম্পর্কেই, মানুষের না-জানার বিষয়টিই এখানে প্রধান। তাই ‘হৃদয়’ বা ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ নামকরণটি এক্ষেত্রে সার্থক হত না। যে-নাম কবিপ্রদত্ত, সেইটাই সার্থক।
৩.৪ সুভাষ মুখােপাধ্যায়-এর লেখার যে-ধরন তােমার চোখে পড়েছে তা নিয়ে বন্ধুকে একটি চিঠি লেখাে।
উঃ নিজের মতো করে লিখে নেবে।
৪.১ অথচ’ শব্দটিকে ব্যাকরণের ভাষায় কী বলি কবিতায় এই ‘অথচ’ শব্দটির প্রয়ােগ কবি কেন করেছেন ?
উঃ ‘অথচ’শব্দটিকে ব্যাকরণের ভাষায় আমরা অব্যয় বলি। » কবিতায় কবি এই কথাটিকে ‘কিন্তু অর্থে ব্যবহার করেছেন। আবার এও বলা যায়, আগের ও পরের বক্তব্যের মধ্যে সংযােগ রক্ষার্থে এই কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেহেতু আগের ও পরের কথাটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। তা ছাড়া বিপরীত ভাব বর্ণনা প্রসঙ্গেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
৫.১ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ পঙক্তিটিতে মােট ক-টি দল ? রুদ্ধদল এবং মুক্তদলের সংখ্যাই বা কত ?
উঃ ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ পঙক্তিটিতে মােট ৯টি দল আছে। যেমন — আ-লা-দি-নের-আশ্ - চর-য-প্র - দীপ। এর মধ্যে রুদ্ধদল ৪টি [নের, আশ্ , চর, দীপ], আর মুক্তদল ৫টি [আ, লা, দি, য, প্র]।
৬.১ কবিতার মধ্যে অসমাপিকা ক্রিয়ার সংখ্যা ক-টি ও কী কী ?
উঃ কবিতার মধ্যে অসমাপিকা ক্রিয়ার সংখ্যা ৫টি। যথা ‘সামলাতে সামলাতে’, ‘দিলেই’, ‘ঢুকতে’, ‘গিলতে গিলতে’, ‘খসে।
0 Comments