শিকল - পরার গান
কাজী নজরুল ইসলাম
বিষয়সংক্ষেপ
হুগলি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন বন্দিদের মনে সাহস জোগানাের জন্য কবি রচনা করেছিলেন ‘শিকল-পরার গান’ কবিতাটি। বন্দি জীবনে ভয়শূন্য হওয়ার জন্য কবি অপূর্ব যুক্তিপূর্ণ কথাগুলি কবিতাটির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। শিকলপরা তাঁদের এক ছলনা মাত্র; কারণ এই শিকল পরেই তাঁরা ব্রিটিশ প্রদত্ত শিকলকে বিকল করবেন। ব্রিটিশের কারাগারে তাঁরা বন্দি হয়ে থাকতে আসেননি—সমস্ত স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমীদের দাসত্বের শৃঙ্খল-ভয়কে দূর করতেই তাঁদের এই কারাবাস। তাঁরা হাতে বেড়ি পরেই, বেড়ি পরার ভয়কে ত্যাগ করবেন। তাঁদের পদযুগল শৃঙ্খলবদ্ধ হওয়ার জন্য নয়, বরং শৃঙ্খলকে চূর্ণ করার যন্ত্রস্বরূপ। ব্রিটিশরা স্বাধীনতাকামী দেশভক্তদের কারাগারে আবদ্ধ করে বিশ্বকে গ্রাস করতে চাইছে এবং ভয় দেখিয়েই বিধির শক্তিকে দুর্বল করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু কবির বক্তব্য, সেই ভয় দেখানাে ভূতের সর্বনাশ করে সাহসিকতার বিজয়মন্ত্র সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং দুর্বলের মধ্যে সারিত করতে হবে অসীম বল।
নামকরণ
সাহিত্যে নামকরণ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার মধ্যে দিয়ে বিষয়ের গভীরতার স্বাদ পাওয়া যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম আলােচ্য কবিতাটির নামকরণ করেছেন ‘শিকল-পরার গান’। কবিতাটিতে কবি শিকল পরার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যক্ত করেছেন। তিনি শিকল পরেই শিকলকে বিকল করতে চান। ব্রিটিশদের কারাগারে তাঁরা প্রবেশ করেছেন বন্দি হয়ে থাকার জন্য নয়। এ শিকলপরা তাঁদের ছলনামাত্র। শিকল পরে কারাগারে ঢুকে তাঁরা সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষদের শৃঙ্খল পরার ভয়কে দূর করতে চান। ব্রিটিশদের ভয়-দেখানােকে ভূতের ন্যায় নাশ করে ভারতবাসীর মনে তিনি সাহস সঞ্চার করতে চান। ফাঁসির দড়ি গলায় পরে দেশমাতৃকার মুখে হাসি ফোটাতে চান। তাঁর পায়ে বেড়ি পরাকে মূলত মুক্তিপথের অগ্রদূতের চরণ বন্দনা বলে উল্লেখ করেছেন কবি। দেশভক্তদের দেহের হাড় দিয়ে বজ তৈরি করে তিনি পুনরায় বজ্রের আগুন প্রজ্বলিত করবেন দেশে। সেই বার্তাই প্রকাশিত হয়েছে কবিতাটির মাধ্যমে। সুতরাং, শিকল-পরার মূল উদ্দেশ্য কবিতাটির মধ্যে ব্যক্ত হওয়ায় কবিতার শিরােনাম ‘শিকল-পরার গান’ হয়েছে। নামটি ব্যঞ্জনাধর্মী হওয়ায় অবশ্যই যথার্থ ও সার্থক হয়েছে।
হাতে কলমে
১.১ কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১.২ তিনি কী কী ধরনের গানের রচয়িতা ?
উঃ কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামাসংগীত, গজল, দেশাত্মবােধক, ইসলামি রাগপ্রধান, হাসির গান প্রভৃতি নানা ধরনের গানের রচয়িতা ছিলেন।
২ নীচের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর একটি বাক্যে লেখাে :
২.১ ‘শিকল-পরা ছল’ বলতে কবি প্রকৃতপক্ষে কী বােঝাতে চেয়েছেন ?
উঃ ‘শিকল-পরা ছল’ বলতে, কবি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের স্বাধীনতা অর্জনে কারাবরণ করে শিকল পরার ভীতি দূর করাকে বােঝাতে চেয়েছেন।
২.২ ‘ক্ষয় করতে আসা মােদের সবার বাঁধন-ভয়। ‘বাঁধন-ভয়’ ক্ষয় করতে কারা, কোথায় এসেছেন ?
উঃ কবি-সহ তাঁর অনুগামী দেশভক্তরা ‘বাঁধন-ভয়’ ক্ষয় করতে ব্রিটিশের কারাগারে এসেছেন।
২.৩ ‘মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা কীভাবে রচিত হয় ?
উঃ দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য ব্রিটিশদের হাতে আক্রান্ত হওয়া এবং মুক্তিকামী দেশভক্তদের পায়ে শিকল পরার মাধ্যমে তাঁদের চরণ-বন্দনা রচিত হয়।
২.৪ মােদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্ৰানল।—পঙক্তিটিতে ‘আবার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কেন?
উঃ পুরাণ কাহিনি অনুসারে, দধীচি মুনির হাড় দিয়ে নির্মিত বজ্রে বৃত্রাসুরকে বধ করা হয়েছিল। বর্তমানে দেশভক্তদের হাড় দিয়ে পুনরায় নির্মিত বজে ইংরেজ শক্তিকে নাশ করার প্রসঙ্গে ‘আবার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
৩ নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখা :
৩.১ স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির বাসনা কীভাবে ‘শিকল-পরার গান কবিতায় ধরা পড়েছে, তা আলােচনা করাে।
উঃ কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিষের বাঁশি কাব্যের অন্তর্গত ‘শিকল-পরার গান কবিতায় সমগ্র স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর মুক্তির বাসনা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কবি ভারতের মুক্তিপিয়াসি মানুষের মনে সাহস জোগানাের জন্য এবং মুক্তির বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য বলেছেন- শৃঙ্খলিত হয়ে তাঁদের কারাগারে প্রবেশ করা একটা ছলনামাত্র। এই শিকল পরেই তাঁরা পরাধীনতার শৃঙ্খলকে চূর্ণ করবেন। এই কারাবরণের মাধ্যমে তারা মুক্তিপিয়াসি মানুষের মন থেকে কারাবরণের ভীতিকে দূরীভূত করতে চান। ব্রিটিশরা যে ভয় দেখিয়ে তাঁদের শাসনজাল বিস্তার করছে, সেই ভয়ের কণ্ঠ রােধ করেই সকলকে সাহসী করে তুলতে চান। আলােচ্য কবিতায় দেশকে ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত করতে সমস্ত কষ্ট স্বীকার করে নিজেদের জীবন বলিদানের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের বার্তা ঘােষিত হয়েছে। কবি বলেছেন, দেশভক্তদের শরীরের হাড় দিয়ে পুনরায় বজ্র তৈরি হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিনাশ ঘটাতে দেশে বজ্রের আগুন জ্বলবে। এভাবেই স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির বাসনা কবিতাটিতে ধ্বনিত হয়েছে।
৩.২ ‘বাঁধন-ভয়কে করব মােরা জয়’—কেন এই বাঁধন ? কারা, কীভাবে এই ‘বাঁধন-ভয়কে জয় করবে ?
উঃ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ তথা সমগ্র ভারতবাসীকে মুক্ত করতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে নামায় রাজদ্রোহিতার অপরাধে কবিসহ তাঁর দেশভক্ত অনুগামীদের ব্রিটিশ কারাগারে আটক করা হয়েছিল।
➡️ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর অনুগামী অন্যান্য দেশভক্তরা নির্দ্বিধায় কারাবরণের মাধ্যমে ইংরেজ শক্তিকে বিকল করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাই কবির উদাত্ত ঘােষণা—“শিকলবাঁধা পা নয় এ শিকলভাঙা কল।।” অর্থাৎ, শিকল পরা তাঁদের একটা ছলনামাত্র। এই ‘শিকল’ পরেই তাঁরা ইংরেজ প্রদত্ত শিকলকে বিনাশ করবেন এবং স্বেচ্ছা কারাবরণের মাধ্যমে মুক্তিপিয়াসি সাধারণ মানুষের মন থেকে কারাবরণের ভীতিকে দূর করবেন।
৪ দল বিশ্লেষণ করাে : বন্ধনী, ঝঞ্ঝনা , বজ্রানল , সর্বনাশ, অস্থি।
➡️ বন্ধনী = বন্-ধ - নী (মুক্তদল—ধ, নী (২ টি), রুদ্ধদল—বন্ (১ টি)]।
➡️ ঝঞ্ঝনা = ঝন্ - ঝ - না [মুক্তদল-ঝ, না (২ টি), রুদ্ধদল-ঝন (১টি)] ।
➡️ বজ্ৰানল = বজ-রা-নল (মুক্তদল—রা (১টি), রুদ্ধদল—বজ, নল (২ টি)]।
➡️ সর্বনাশ = সর-ব-নাশ (মুক্তদল - ব (১টি), রুদ্ধদল সর, নাশ (২ টি)]।
➡️ অস্থি = অস্-থি (মুক্তদল-থি (১টি), রুদ্ধদল—অস্ (১টি)]।
৫ ধ্বনি পরিবর্তনের কোন নিয়ম এখানে কাজ করেছে দেখাও : বাঁধন, পরে।
➡️ বাঁধন = বন্ধন > বাঁধন (নাসিকীভবন)।
➡️ পরে= পরিয়া > পইর্যা > পরে (অভিশ্রুতি)।
৬ বাক্যে রূপান্তর করাে :
৬.১ ভয়-দেখানাে ভূতের মােরা করব সর্বনাশ। (জটিল বাক্যে)
উঃ ভয় দেখানাে যে ভূত আমরা তার সর্বনাশ করব।
৬.২ মােরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যুজয়ের ফল। (যৌগিক বাক্যে)
উঃ মােরা ফাঁসি পরব এবং মৃত্যুজয়ের ফল স্বরূপ হাসি আনব।
৬.৩ তােদর বন্ধ কারায় আসা মােদের বন্দী হতে নয়। (চলিত গদ্যে)
উঃ তােদের বন্ধ কারায় আমাদের বন্দি হতে আসা নয়।
৭ পদ চিহ্নিত করাে :
৭.১ তােমরা বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্বগ্রাস।
উঃ তােমরা— সর্বনাম, বন্ধ— বিশেষণ, ঘর — বিশেষ্য, বন্ধনী — বিশেষ্য, করছ — ক্রিয়া, বিশ্বগ্রাস — বিশেষ্য।
৭.২ মােরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যু জয়ের ফল।
উঃ মােরা — সর্বনাম, ফাঁসি — বিশেষ্য, পরে — ক্রিয়া, আনব — ক্রিয়া, হাসি — বিশেষ্য, মৃত্যু জয় — বিশেষ্য, ফল — বিশেষ্য।
৭.৩ এবার আনব মাভৈঃ-বিজয়মন্ত্র বলহীনের বল।
উঃ এবার — অব্যয়, আনব — ক্রিয়া, মাভৈঃ — বিশেষণ, বিজয়মন্ত্র — বিশেষ্য, বলহীন — বিশেষণ, বল — বিশেষ্য।
৮ ব্যাসবাক্য-সহ সমাসের নাম লেখাে :
➡️ শিকল-ঝঞ্জনা = শিকলের ঝঞ্চনা–সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস।
➡️ চরণ বন্দনা = চরণকে বন্দনা — কর্ম-তৎপুরুষ সমাস;চরণের বন্দনা — সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস।
➡️ বজ্ৰানল = বজের অনল — সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস; ব্রজ রূপ অনল — রূপক কর্মধারয় সমাস।
➡️ মৃত্যুজয় = মৃত্যুকে জয় — কর্ম তৎপুরুষ সমাস ; মৃত্যু হতে জয় — অপাদান তৎপুরু সমাস।
5 Comments
'শিকল পরার গান কবিতা নজরুল কী বোঝাতে চেয়েছেন ?? Ai questions ta dorkar
ReplyDeleteকবি কাজী নজরুল ইসলাম 'শিকল পরার গান' কবিতার মাধ্যমে সমস্ত ভারতবাসীর কাছে ইংরেজদের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার বার্তা প্রেরণ করেছেন। তিনি এই কবিতার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন যে ইংরেজরা ভারতীয়দের শিকল দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলেও তাদের দমিয়ে রাখা যাবে না। তিনি মানুষের মনে শক্তি জুগিয়েছেন।
Deleteশিকল কিসের প্রতীক
ReplyDeleteশিকল বন্দিত্বের প্রতীক ।
Deleteম দিয়ে ছেলেদের ইসলামিক নাম
ReplyDelete