টিকিটের অ্যালবাম
সুন্দর রামস্বামী
বিষয়সংক্ষেপ
রাজাপ্পা আর নাগরাজন পরস্পরের সহপাঠী। দুজনেই দেশবিদেশের টিকিট জমায়। দুজনেরই টিকিটের অ্যালবাম আছে। কিন্তু নাগরাজনের অ্যালবামটা ঘিরে সকলেরই কৌতূহল আর তার চারপাশে সকলের ঘােরাঘুরি। নাগরাজনের এই জনপ্রিয়তায় রাজাপ্পা একটু দুঃখ পেল। অথচ, একসময় তার অ্যালবামটাই বিখ্যাত ছিল। আর তার জন্য সে কী না-করেছে! ভাের থেকে বিকেল সবসময় ঘুরে বেড়িয়েছে টিকিটের জন্য। এখন সে এসব কথা ভাবে আর কষ্ট পায়।
নাগরাজনের অ্যালবামটা তার কাকা পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। তবে রাজাপ্পার অ্যালবামও ছিল আকর্ষণীয়। রাজস্ব বিভাগের এক অফিসারের ছেলে সেটা পঁচিশ টাকায় কিনতেও চেয়েছিল, কিন্তু রাজাপ্পা দেয়নি। রাজাপ্পার রাগ আরও বেড়ে যায়, নাগরাজনের অ্যালবামে লেখা তার কাকার একটি কথায়, যার অর্থ পৃথিবী যতদিন স্বাভাবিক, ততদিন অ্যালবামের ওপর নাগরাজনের অধিকার ওই কথাগুলিই অন্যান্য বন্ধু-সহপাঠীরা তাদের অ্যালবামে কিংবা বই-খাতায় টুকে নিচ্ছিল।
ক্ষুব্ধ রাজাপ্পা এরপর আর নিজের অ্যালবামের পাতা ওলটায় না। ছোঁয় না। সেটা যেন একটা ছেড়া ন্যাতা। একবার একটা ফন্দি আঁটল সে মনে মনে। সন্ধেবেলায় ছুটল নাগরাজনের বাড়ি। নাগরাজন বাড়িতে নেই। পাশের বাড়ি আপ্পকে নিয়ে সে শহরে গিয়েছে। তার ছােটোবােন কামাক্ষী এল। জিজ্ঞেস করল, তার ভায়ের অ্যালবামটা সে দেখেছে কি না। রাজাপ্পা জানাল, সেটা বেঢপ । কামাক্ষী চলে গেল। সেই সুযােগে রাজাপ্পা নাগরাজনের বইয়ের টেবিল থেকে চাবি খুঁজে নাগরাজনের টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করল তার অ্যালবাম। তারপর তার হাফপ্যান্টের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে সটান নিজের বাড়ি চলে এল।
অ্যালবাম চুরি করে রাজাপ্পার শরীর তপ্ত হয়ে ওঠে, গলা শুকোয়, মাথায় শুরু হয় রক্তচাপ। রাত আটটার সময় আপ্প তার বাড়ি এল অ্যালবাম চুরির খবর নিয়ে। রাজাপ্পার অস্বস্তি হয়। আল্লু চলে যেতেই সে অ্যালবামটা বইয়ের তাকের পিছনে থেকে বের করে আবার সেখানেই রাখে। তার রাত্রের খাওয়া মাথায় ওঠে। অ্যালবামটা বের করে সে বালিশের তলায় রেখে দিল। ঘুম ভাঙার আগেই আবার আঙ্গু এসে হাজির হল সকালবেলায়। সে তাকে জিজ্ঞেস করল, গতকাল সে নাগরাজনের বাড়ি গিয়েছিল কি না। এ ছাড়াও সে উল্লেখ করল, নাগরাজন পুলিশকর্মীর ছেলে। সুতরাং, এ বিষয়ে পুলিশি হাঙ্গামাও হতে পারে। এমনসময় আঙ্গুর ভাই আপ্পকে ডাকতে এল। রাজাপ্পা দেখল, অ্যালবামটা তার কাছে রাখা বিপজ্জনক। সে তখন বাড়ির পিছনে স্নানের জল গরম করার একটা বড়াে উনুনে অ্যালবামটা ফেলে দিল। অশ্রুসিক্ত হল তার চোখ।
রাজাপ্পার স্নানের পর নাগরাজন এল তার বাড়ি। সে বলল, তার সুরক্ষিত অ্যালবামটা কীভাবে চুরি হয়েছে। অনেক কথা শােনার পর রাজাপ্পা জোরপূর্বক নাগরাজনকে তার অ্যালবামটা দিয়ে দিল। বিস্মিত হল নাগরাজন। অ্যালবামটা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই রাজাপ্পা বলল, শুধু আজকের রাতটার জন্য যদি সে অ্যালবামটা তাকে একবার দেয়, তাহলে ভালাে হয়। সে পরদিন ফেরত দেবে। নাগরাজন তাই করল। রাজাপ্পা সেটা জাপটে ধরে কাঁদতে লাগল হুহু করে।
নামকরণ
সাহিত্যে নামকরণ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার মধ্য দিয়ে পাঠকরা সাহিত্য বিষয়টি সম্পর্কে আংশিক ধারণা লাভ করতে পারে। নামকরণ মূলত নানা প্রকারের হতে পারে। যেমন—চরিত্রকেন্দ্রিক, বিষয়কেন্দ্রিক, ব্যঞ্জনাধর্মী, উপমাবাচক ইত্যাদি। তামিল সাহিত্যিক সুন্দর রামস্বামীর ‘টিকিটের অ্যালবাম’ নামক গল্পটি গড়ে উঠেছে দুই কিশাের রাজাপ্পা ও নাগরাজনের ডাকটিকিট সংগ্রহের প্রতি নেশা এবং তাদের টিকিটের অ্যালবামটিকে কেন্দ্র করে।‘টিকিটের অ্যালবাম আসলে ডাকটিকিটের অ্যালবাম। অর্থাৎ, দেশবিদেশের ডাকটিকিট জমানাে এক-একজনের শখ। রাজাপ্পা আর নাগরাজন পরস্পরের সহপাঠী-বন্ধু। তারা দুজনেই এরকম টিকিট জমায়। রাজাপ্পার অ্যালবামটা আগে ভালাে ছিল, কিন্তু বর্তমানে নাগরাজনেরটা ভালাে এবং অদ্বিতীয় সুন্দর। পুরাে গল্পে এই অ্যালবাম নিয়েই নানা কথা বলা হয়েছে। নাগরাজনের জনপ্রিয়তা, রাজাপ্পার হিংসা, নাগরাজনের বন্ধুদের কৌতূহল, রাজাপ্পার অ্যালবামকে নিন্দা, অ্যালবামের জন্য রাজাপ্পার ছােটাছুটি, রাজাপ্পার নাগরাজনের বাড়ি যাওয়া, অ্যালবাম চুরি, রাজাপ্পার নিজের অ্যালবামের প্রতি উদাসীনতা, তার খাওয়ার প্রতি অনীহা, মনােকষ্ট, নাগরাজনের অ্যালবাম পােড়ানাে এবং সবশেষে নিজের অ্যালবাম নাগরাজনকে দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সমস্তকিছুই একটি বিষয় বা ঘটনানির্ভর, সেটা হল ডাকটিকিটের অ্যালবাম। সেটা ঘিরেই অল্পবয়সি দুটি সহপাঠী-বন্ধুর ভালাে লাগা-মন্দ লাগা, স্বপ্ন, শখ, হিংসা, ঘৃণা ইত্যাদি দেখা গিয়েছে আলােচ্য গল্পে। টিকিটের অ্যালবামই গল্পের মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। সেজন্য এই গল্পের নামকরণ ‘টিকিটের অ্যালবাম’ যথার্থ ও সার্থক হয়েছে।
হাতে কলমে
১.১ সুন্দর রামস্বামী কোন ভাষার লেখক ? উঃ সুন্দর রামস্বামী তামিল ভাষার লেখক।
১.২ তিনি কোন্ ছদ্মনামে লিখতেন ? উঃ তিনি ‘পদুবিয়া’ ছদ্মনামে লিখতেন।
২ নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর দাও :
২.১ টিকিটের অ্যালবাম’ গল্পের লেখক কে ?
উঃ ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্পের লেখক সুন্দর রামস্বামী।
২.২ মূল গল্পটি কোন ভাষায় রচিত ?
উঃ মূল গল্পটি তামিল ভাষায় রচিত।
২.৩ গল্পটিতে মােট কটি চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় ?
উঃ গল্পটিতে মােট তেরােটি চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। (প্রধান চরিত্র হল রাজাপ্পা, নাগরাজন, আন্ধু ও কামাক্ষী। গৌণ চরিত্রের মধ্যে আছে পার্বতী, কৃয়ান, রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীর ছেলে, নাগরাজনের বাবা, নাগরাজনের কাকা, রাজাপ্পার বাবা-মা, পিয়ােন আর আঙ্গুর ভাই )
২.৪ মেয়েদের পক্ষ থেকে কে নাগরাজনের থেকে অ্যালবামটি চেয়ে নিয়ে যেত ?
উঃ মেয়েদের পক্ষ থেকে ডানপিটে পার্বতী নাগরাজনের থেকে অ্যালবামটি চেয়ে নিত।
২.৫ রাজাপ্পা কীভাবে তার অমূল্য ডাকটিকিটগুলি সংগ্রহ করত ?
উঃ মৌমাছিরা যেমন মধুসংগ্রহ করে, রাজাপ্পা সেইভাবে ডাকটিকিট সংগ্রহ করত। সে ভােরবেলা বেরিয়ে পড়ত টিকিট সংগ্রাহকদের সঙ্গে দেখা করতে। একটি রাশিয়ান টিকিটের সঙ্গে বিনিময় করত দুটি পাকিস্তানি টিকিট। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে প্যান্টের পকেটে জলখাবার নিয়ে চোঁ সঁচা করে এক কাপ কফি খেয়ে সে আবার বেরিয়ে পড়ত। একটি কানাডার টিকিটের জন্য সে চার মাইল দূর পর্যন্তও যেত।
২.৬ নাগরাজনের অ্যালবামটি তাকে কে উপহার দিয়েছিলেন ?
উঃ নাগরাজনের অ্যালবামটি তাকে তার কাকা উপহার দিয়েছিলেন।
২.৭ সেই অ্যালবামের প্রথম পাতায় কী লেখা ছিল ?
উঃ অ্যালবামের প্রথম পাতায় লেখা ছিল : “এই অ্যালবামটি চুরি করতে চেষ্টা করছ যে নির্লজ্জ হতভাগা, তাকে বলছি. ওপরে আমার নামটা দেখেছ? এটা আমার অ্যালবাম। এটা আমার এবং যতদিন ঘাসের রং সবুজ আর পদ্মফুল লাল, সূর্য পূর্বে উঠবে আর পশ্চিমে অস্ত যাবে একমাত্র আমারই থাকবে।”
৩ নীচের প্রশ্নগুলির সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :
৩.১ নাগরাজনের অ্যালবামের প্রতি সকলে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল কেন ?
উঃ নাগরাজনের অ্যালবামটা তার কাকা তাকে সিঙ্গাপুর থেকে পাঠিয়েছিলেন। টিকিট কম ছিল তাতে, তবু স্থানীয় দোকানে অমন অ্যালবাম পাওয়া যায় না। এ ছাড়া তাতে ইন্দোনেশীয় এক সুন্দরীর ছবিও আছে। যা রাজাপ্পার অ্যালবামে নেই। তাই তার অ্যালবামের প্রতি সকলে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল।
৩.২ ''কেটে পড় হিংসুটে পােকা!'' ---বক্তা কে ? কাকে সে এমন কথা বলেছে ? তুমি কি এই কথার মধ্যে কোনাে যুক্তি খুঁজে পাও ?
উঃ সুন্দর রামস্বামীর লেখা ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্প থেকে নেওয়া উক্তিটির বক্তা রাজাপ্পা ও নাগরাজনদের সহপাঠী কৃয়ান।
➡️ ক্লাসের সবাই নাগরাজনের অ্যালবামের প্রতি আকৃষ্ট হলে রাজাপ্পা সবার ওপর রেগে যায়। তার রেগে যাওয়ার কারণে কৃষান, রাজাপ্পাকে এমন কথা বলেছে।
➡️ হ্যা, আমি এই কথার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পাই । তা হল প্রথমত, সদ্য অ্যালবাম পাওয়ার ফলে নাগরাজনের জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সেটি এসেছে সিঙ্গাপুরবাসী নাগরাজনের কাকার কাছ থেকে। তৃতীয়ত, তাতে ছবি ছিল অসাধারণ। যেমন, ইন্দোনেশিয়ার এক সুন্দরীর ছবি। চতুর্থত, নাগরাজনের অ্যালবামে লেখা ছিল বেশ কিছু সুন্দর কথাবার্তা, যা তার অন্যান্য সহপাঠীরা নিজেদের বই খাতায় লিখে নিচ্ছিল এবং তাই নিয়ে সে রেগে গিয়ে কয়েকটি কথাও বলেছিল। এই কথার জন্যই রাজাপ্পাকে তার সহপাঠী উক্ত কথাটি বলেছিল।
৩.৩ ''এদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই।''—উপলদ্ধিটি কার ? কী বিষয়ে তর্কের প্রসঙ্গ এসেছে ? তর্ক করে লাভ নেই কেন ?
উঃ তামিল সাহিত্যিক সুন্দর রামস্বামীর লেখা ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্পের প্রশ্নোক্ত উপলব্ধিটি ক্লাসের অন্যতম ডাকটিকিট সংগ্রহকারী রাজাপ্পার। রাজাপ্পা ও নাগরাজনের অ্যালবামের মান নিয়ে তর্কের প্রসঙ্গ এসেছে।
➡️ নাগরাজনের অ্যালবামটা রাজাপ্পার অ্যালবামের তুলনায় ভালাে এবং সেইটিকে ঘিরেই সবাই থাকে। তার ওপর সেটি সিঙ্গাপুর থেকে তার কাকা তাকে পাঠিয়েছে। অন্যান্যরা রাজাপ্পার অ্যালবামকে বাজে বলেছে। কৃয়ানও বলেছে, সেটি ডাস্টবিনে রাখার যােগ্য। অথচ ছাত্রদের কেউ বুঝতে চায় না সে, তার অ্যালবামটি যথেষ্ট বড়াে এবং তাতে বহু দুমূল্য টিকিট আছে। আর এ ব্যাপারটিকেই সে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। কিন্তু এতসব করেও কোনাে লাভ হয় না। এমত অবস্থায় অন্যদের কাছে অ্যালবামের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করাকে রাজাপ্পার মনে হয়েছে অর্থহীন। তাই সে ভেবেছে, তর্ক করে লাভ নেই।
৪ নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখাে :
৪.১‘হঠাৎ যেন ওর জনপ্রিয়তা কমে গেছে’ -কার এমন মনে হয়েছে ? এই জনপ্রিয়তা হঠাৎ কমে যাওয়ার কারণ কী ?
উঃ প্রখ্যাত তামিল সাহিত্যিক সুন্দর রামস্বামীর লেখা ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্পের উক্ত কথাটি ডাকটিকিট সংগ্রাহক ছাত্র রাজাপ্পার এমন মনে হয়েছে।
➡️এই জনপ্রিয়তা হঠাৎ কমে যাওয়ার কারণ হল— নাগরাজনের অ্যালবামটা রাজাপ্পার অ্যালবামের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। তার ওপর সেটা তার কাকা সিঙ্গাপুর থেকে পাঠিয়েছে। তা ছাড়া, স্থানীয় কোনাে দোকানে অমন অ্যালবাম পাওয়া যায় না। আর তাতে ছবিগুলিও ছিল ভালাে, যেমন ইন্দোনেশিয়ার এক সুন্দরীর ছবিটি ছিল খুবই সুন্দর। তাতে ডাকটিকিট কম থাকলেও নাগরাজন নিজের সুন্দর ব্যবহারে সবাইকে আকৃষ্ট করে তুলেছিল। এমনকি সে নিজেই পাতা উলটে আনন্দিত চিত্তে সবাইকে অ্যালবামটি দেখাত। সর্বোপরি, তার অ্যালবামে নতুনত্ব ছিল বলে সকলেই কৌতূহলী হয়ে তাকে ঘিরে থাকত। একারণেই রাজাপ্পার জনপ্রিয়তা কমে যায়।
৪.২ কেউ রাজাপ্পার অ্যালবামের কথা উল্লেখও করত না, বা তাকে পাত্তাও দিত না। সকলের এমন আচরণের কারণ গল্প অনুসরণে আলােচনা করাে।
উঃ সকলের এমন আচরণের কারণ একটি ই– নাগরাজনের অ্যালবামটি ছিল রাজাপ্পার অ্যালবামের চেয়ে আকর্ষণীয়। আর সেটা নিয়ে সহপাঠী বন্ধুরা সবসময় কৌতূহলী হয়ে তাকে ঘিরে থাকত। উদ্দেশ্য ছিল, নাগরাজনের অ্যালবামটা দেখা। স্কুলের ঘণ্টা পড়ার আগে, দুপুরের ঘণ্টা পড়ার পরে সব সময় সুযােগ পেলেই সকলে তার অ্যালবাম নিয়ে ভিড় জমাত। যদিও নাগরাজন তা কাউকে হাতে দিত না। সন্ধেবেলা পর্যন্ত নাগরাজনের বাড়ি সকলে ধাওয়া করত। এতকিছুর পরেও নাগরাজন কোনাে বিরক্তি প্রকাশ করত না। এমনকি কখনও ধৈর্যচ্যুত হত । ফলে সবাই প্রাণভরে, আশ মিটিয়ে অ্যালবাম দেখতে পারত। অন্যদিকে, রাজাপ্পা ছিল কটুভাষী ও আচরণে রূঢ়। তা ছাড়া নাগরাজনের অ্যালবামটি ছিল বিদেশি। তাতে টিকিট কম থাকলেও অ্যালবামটি খুবই আকর্ষণীয় ছিল। এসব কারণে কেউ রাজাপ্পার অ্যালবামের কথা তুলত না, বা তাকে পাত্তা দিত না। তার
৪.৩ স্কুলের ছেলেমেয়েদের নাগরাজন কীভাবে নিজের অ্যালবামটি দেখতে দিত ?
উঃ নাগরাজন স্কুলের ছেলেমেয়েদের অ্যালবামটা দেখতে দিত খুব সাবধানে। সে একটা শর্ত দিয়েছিল যে, অ্যালবামটা কেউ ধরবে না। এজন্য সে সেটা নিজের কোলে রেখে পাতা ওলটাত আর প্রাণভরে সকলে দেখত। মেয়েদের মধ্যে ডানপিটে পার্বতী যখন অ্যালবাম চেয়েছিল, সে তখন তাতে একটি মলাট লাগিয়ে দিয়েছিল।
৪.৪ ডাকটিকিট সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে রাজাপ্পার তীব্র আকর্ষণের যে পরিচয় গল্পে রয়েছে তা আলােচনা করাে।
উঃ রাজাপ্পার ডাকটিকিট সংগ্রহের ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সাধারণত সে শনি ও রবিবার ছােটাছুটি করত ডাকটিকিটের জন্য। কোথায়, কার কাছে, কোন্ শের টিকিট, কখন পাওয়া যাবে—সব তার জানা ছিল। মৌমাছি যেমন মধু সংগ্রহ করে মৌচাক তৈরি করে, তেমনই সে ডাকটিকিট সংগ্রহ করে একটু একটু করে সুন্দর করে তুলেছিল তার অ্যালবাম। এজন্য সে ভােরবেলা, বিকেলবেলা সব সময়ই ছুটত। বিনিময় করত একটি রাশিয়ার টিকিটের সঙ্গে দুটো পাকিস্তানি টিকিট, কিংবা ছুটে যেত চার মাইল দূরে একটা ছেলের কাছে, কানাডার টিকিট পাবে বলে। এমনকি ডাকটিকিটের জন্য সে বিকেলবেলা পড়ত। এমনই ছিল তার টিকিট সংগ্রহ করার তীব্র আকর্ষণ।
৪.৫ ‘চোরাদৃষ্টিতে অ্যালবামটা দেখত’– সেই চোরাদৃষ্টিতে দেখা অ্যালবামটির কোন্ বিশেষত্বের কথা গল্পে রয়েছে ?
উঃ তামিল ভাষার প্রখ্যাত গল্পকার সুন্দর রামস্বামীর লেখা ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্প থেকে নেওয়া আলােচ্য অংশে রাজাপ্পার তির্যক ঈষাকাতর দৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। নাগরাজনের কাকা সিঙ্গাপুর থেকে এটি পাঠিয়েছিল। স্কুলের ছেলেমেয়েরা সেই অ্যালবাম নিয়েই মেতে থাকত। ফলে রাজাপ্পার এতদিনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে সহসা নাগরাজনের কদর বেড়ে যায়। ছেলেমেয়েরা রাজাপ্পার অ্যালবাম নিয়ে মাথা ঘামায় না। সবাই নাগরাজনের অ্যালবাম নিয়েই উৎসাহ দেখায়। তাতেই রাজাপ্পা আরও বেশি রেগে যায়। কিন্তু সেই রাগ কপট আসলে মনে প্রবল ঈর্ষা নিয়ে রাজাপ্পা চোরাদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত যে, নাগরাজনের অ্যালবামটি সত্যিই অপরূপ সুন্দর। তার তুলনা হয় না। স্থানীয় কোনাে দোকানেই এমন অতুলনীয় অ্যালবাম পাওয়া যায় না। রাজাপ্পার দৃষ্টি তীক্ষ ও অভিজ্ঞ বলে সে বুঝতে পারে, এমন অ্যালবামের ওপর সবার আকর্ষণ তাে থাকবেই। আর এভাবেই রাজাপ্পার চোরাদৃষ্টিতে নাগরাজনের অ্যালবামের বিশেষত্ব ধরা পড়েছিল।
৪.৬ নাগরাজনের প্রতি রাজাপ্পা কীভাবে ক্রমশ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল ?
উঃ রাজাপ্পা যখন দেখল, গত তিনদিন ধরে তার সহপাঠী বন্ধুরা নাগরাজনের চারপাশে ভিড় জমাচ্ছে, তখন সে তাদের বােঝাল যে, নাগরাজন দাম্ভিক। কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল না। এমতাবস্থায় রাজাপ্পা বুঝল যে, তার আর জনপ্রিয়তা নেই। পরিবর্তে নাগরাজনের অ্যালবামকে ঘিরে বন্ধুদের অধীর আগ্রহ। কারণ সেটি বিদেশ থেকে পাঠানাে। কোনাে স্থানীয় দোকানেই এমন অতুলনীয় অ্যালবামটি পাওয়া যায় না। তবে ঈর্ষার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল, নাগরাজনের অ্যালবামে তার কাকার একটি লেখাকে ঘিরে। সহপাঠীরা সেই লেখাটি নিজের বই-খাতায় লিখে নিল। তখন সে তাদের বন্ধুদের নকলনবিশ বলে ঠাট্টা করেছিল। তাতেও তার বন্ধুরা তাকে পাত্তা না দিয়ে, উলটে তাকে হিংসুটে বললে, রাজাপ্পার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। নাগরাজনের অ্যালবামের জনপ্রিয়তা সে মেনে নিতে না-পারায় ক্রমেই নাগরাজনের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল।
৪.৭ সন্ধ্যাবেলা রাজাপ্পা নাগরাজনের বাড়ি গেল। কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে রাজাপ্পা নাগরাজনের বাড়িতে গিয়েছিল ? এর মধ্যে দিয়ে তার চরিত্রের কোন দিকটি ধরা পড়ে ?
উঃ সুন্দর রামস্বামীর লেখা ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্পের রাজাপ্পা ক্লাসের বন্ধু বান্ধবদের কাছে অবহেলিত ও উপেক্ষিত হওয়ায় মনে মনে প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে নাগরাজনের ওপর। আর এর প্রতিশােধ নিতে এবং এতদিনের উপেক্ষা, অবহেলা আর অসম্মানের যথাযােগ্য প্রত্যুত্তর দিতে নাগরাজনের সঙ্গে বােঝাপড়া করতে সে তার বাড়িতে যায়। কিন্তু ঘটনাক্রমে নাগরাজন বাড়িতে না-থাকায় রাজাপ্পা তার অ্যালবামটি চুরি করে আনে।
➡️ ক্রুদ্ধ রাজাপ্পার নাগরাজনের বাড়ি যাওয়ার মাধ্যমে আমরা তার চরিত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাই— (১) রাজাপ্পা মানসিকতার দিক দিয়ে হিংসুটে ও ঈর্ষান্বিত। (২) অন্যের খ্যাতিকে সে ভালাে চোখে দেখে না। (৩) রাজাপ্পার মধ্যে একটি কর্তৃত্ব করার মানসিকতা আছে, যা শিশুসুলভ আচরণের মধ্যে পড়ে না। (৪) রাজপ্পার মধ্যে সহনশীলতার বড়াে অভাব। (৫) বন্ধুত্বসুলভ আচরণ তার মধ্যে কমই দেখা যায়। বরং, সে জেদি, অহমিকাবােধ সম্পন্ন ও উন্নাসিক। আর এর মধ্য দিয়ে রাজাপ্পার চরিত্রের হীনম্মন্যতা, কুরতা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষাপরায়ণতা ইত্যাদি দিকগুলি ধরা পড়ে।
৪.৮ ‘রাজাপ্পার চোখ জলে ভরে গেল।''--- কোন পরিস্থিতিতে রাজাপ্পার চোখ জলে ভরে উঠল ?
উঃ ‘বাড়িতে পুলিশ এসেছে’—এই সন্দেহে রাজাপ্পা নাগরাজনের বাড়ি থেকে চুরি করে আনা অ্যালবামটি পুড়িয়ে ফেলে। তারপরই তার আচরণে মর্মস্পর্শী ভাব ফুটে ওঠে।
কাকার দেওয়া সিঙ্গাপুরের অ্যালবামটি স্কুলে আনার পর থেকে একদিকে যেমন নাগরাজনের জনপ্রিয়তা বাড়ে, অন্যদিকে তেমনই রাজাপ্পার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। ফলে, সে নাগরাজনের প্রতি প্রবল ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। এব্যাপারে চরম বােঝাপড়া করার ইচ্ছায় রাজাপ্পা তার বাড়িতে হাজির হয়। নাগরাজনের অনুপস্থিতির সুযােগ নিয়ে তার ড্রয়ার খুলে জামার নীচে লুকিয়ে অ্যালবামটি নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর থেকে সে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। চুরি করার গ্লানি তাকে আরও বেশি লজ্জিত করে রাখে। প্রতিবেশী বন্ধু আন্ধুর থেকে রাজাপ্পা শােনে, নাগরাজনের বাবা পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। নানান দুশ্চিন্তায় রাজাপ্পা যখন শঙ্কিত, সে সময় দরজায় টোকা পড়ে। অ্যালবামটি বালিশের নীচে রেখে সে শান্তি পায় না। এদিকে দরজায় টোকা পড়া চলতে থাকে। রান্নাঘর থেকে তার মা এসে দরজা খােলার আগেই নিরুপায় সন্ত্রস্ত রাজাপ্পা ছুটে পিছনের স্নানের ঘরে চলে যায়। সেখানে জল গরম করার জন্য জলন্ত বড়াে উনানের আগুনে অ্যালবামটি পুড়িয়ে নিজের অপরাধের প্রমাণ নষ্ট করে দেয়। সেই সঙ্গে বেশ কিছু মূল্যবান ডাকটিকিটও পুড়ে যায়। অমূল্য ডাকটিকিট পুড়ে যাওয়া, সুন্দর অ্যালবামটি ভস্মীভূত হওয়া সর্বোপরি চুরির মতাে মারাত্মক অপরাধের অনুশােচনায় রাজাপ্পার চোখ জলে ভরে যায়।
৪.৯ ‘নাগরাজন হতবুদ্ধি হয়ে গেল।'—তার হতবুদ্ধি হয়ে পড়ার কারণ কী ?
উঃ প্রখ্যাত তামিল সাহিত্যিক সুন্দর রামস্বামীর লেখা ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্পের শেষে রাজাপ্পার আচরণ দেখে নাগরাজনের হতবুদ্ধি হওয়ার কথা বলা আছে। শহর থেকে ফিরে নাগরাজন বুঝতে পারে যে, তার অ্যালবাম হারিয়ে গিয়েছে। সে বােনের কাছে জানতে পারে, তার শহরে যাওয়ার পর রাজাপ্পা তাদের বাড়ি গিয়েছিল। এরপর দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে, চোখে-মুখে কান্নার ছাপ নিয়ে নাগরাজন রাজাপ্পার বাড়ি আসে। নিজের অ্যালবাম হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনিয়ে কাঁদতে থাকে। রাজাপ্পা সান্ত্বনা দেয়। সেইসঙ্গে ভিতরে ভিতরে নিজের কাজের জন্য অনুশােচনায় দগ্ধ হতে থাকে। নাগরাজনের নিপাপ, অভিযােগহীন, ব্যথিত, সকরুণ দৃষ্টি রাজাপ্পা সহ্য করতে পারছিল না। তা ছাড়া সে নিজে অ্যালবামের ও টিকিটের গুরুত্ব বােঝে। যন্ত্রনাদগ্ধ নাগরাজনকে এমন অবস্থায় দেখে রাজাপ্পা এক অত্যাশ্চর্য সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের পরম প্রিয় স্বপ্নের অ্যালবামটি সে বিনা শর্তে নাগরাজনকে দিয়ে দেয়। অথচ, সে জানে এই টিকিট গুলাে ছাড়া তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হবে না। তা সত্ত্বেও বুকে যন্ত্রণা চেপে নাগরাজনকে বলে— “..এটা তাের জন্য। বাড়ি নিয়ে যা। দয়া করে নে, নিয়ে চলে যা।” নাগরাজন এতদিন যে রাজাপ্পাকে দেখে এসেছে, আজ তার বদল হয়েছে। তাই উদ্ধত, কটুভাষী, ডাকটিকিটের জন্য বেপরােয়া রাজাপ্পার আজ ভারাক্রান্ত শান্ত সমাহিত ভাব দেখে নাগরাজন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।
৪.১০ কৃতকর্মের জন্য অনুশােচনার আগুনে দগ্ধ হয়েই ‘টিকিটের অ্যালবাম’ গল্পে রাজাপ্পার আত্মশুদ্ধি ঘটেছে।”–গল্পের ঘটনা বিশ্লেষণ করে উদ্ধৃতিটির যথার্থতা প্রতিপন্ন করাে।
উঃ নাগরাজনের অ্যালবামটি থাকার জন্য রাজাপ্পার অ্যালবামটি কেউ দেখতে চাইত না। সেটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মতাে বাজে জিনিসও ভেবেছিল কেউ কেউ। এই ঘটনায় রাজাপ্পা মনের দুঃখে তার অ্যালবামের পাতাও ওলটাত না। ভিতরে ভিতরে সে এক তীব্র জ্বালা ও ঈর্ষায় ভুগছিল। এজন্য সে ভাবল, এর সব কিছুর মূলে আছে নাগরাজনের অদ্বিতীয় অ্যালবাম। তাই সেটির এমন ব্যবস্থা হওয়া উচিত, যাতে নাগরাজনের অহংকার চূর্ণ হয়। সেজন্য রাজাপ্পা সেটিকে চুরি করে পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই কাজের জন্য সে অনুতপ্ত হয়, দুঃখ পায়। তাই সেই অনুশােচনা ও দুঃখতাপকে কিছুটা দূর করে শান্তি পাওয়ার জন্য নিজের অ্যালবামটি নাগরাজনকে দিয়ে দেয়। এই ঘটনায় বলা যেতে পারে রাজাপ্পার আত্মশুদ্ধি ঘটেছে।
৫ নীচে তােমাদের জন্য কয়েকটি ভারতীয় ডাকটিকিটের ছবি দেওয়া রইল।তােমরা এমনই অনেক ভারতের কিংবা অন্যান্য দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহ করে একটি অ্যালবাম তৈরি করাে।
0 Comments